কারণে বা অকারণে যে কারও মন খারাপ হতেই পারে। কোনো কিছু নিজের ইচ্ছেমতো হলো না তো মন খারাপ। অফিসের বস ধমক দিয়েছে, মন খারাপ। পরীক্ষায় ভালো ফল হয়নি, মন খারাপ। প্রিয়জনের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, তাতেও মন খারাপ।
এই সাধারণ মন খারাপ বা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় স্যাডনেস, সেটা কিন্তু বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন নয়। মন খারাপ বা স্যাডনেস হচ্ছে মানুষের একটি স্বাভাবিক আবেগ। অন্য দিকে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন হচ্ছে সেই আবেগের অস্বাভাবিক বা দীর্ঘমেয়াদি বহিঃপ্রকাশ। অনেক সময় আমরা মন খারাপকে বিষণ্নতা মনে করে মুষড়ে পড়ি, আবার বিষণ্নতাকে সামান্য মন খারাপ ভেবে গুরুত্ব দিই না। এই দুটো বিষয়ের কিছু পার্থক্য রয়েছে।
দুঃখবোধ একটি মৌলিক আবেগ। সুস্থ মানুষের জীবনে দুঃখবোধ হওয়া এবং মন খারাপ থাকা স্বাভাবিক ঘটনা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘বিষণ্নতা’ বা ‘ডিপ্রেশন’ বলতে যা বোঝায়, তা সাধারণ মন খারাপের চেয়ে কিছু বেশি। বিষণ্নতার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। শরীর ও মনের ভেতর থেকে এই ‘এন্ডোজেনাস’ বিষণ্নতার উৎপত্তি। আবার কখনো বিভিন্ন ব্যক্তিগত বা সামাজিক কারণে সৃষ্ট দুঃখবোধ যদি অযৌক্তিকভাবে বেশি তীব্র ও দীর্ঘ সময় বিরাজমান থাকে, তখন তাকে বলে ‘রি-অ্যাকটিভ’ বিষণ্নতা।
বিষণ্নতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মন খারাপ বা দুঃখবোধ বা স্যাডনেস। কিন্তু কেবল এই মন খারাপকেই বিষণ্নতা বলা যাবে না। মন খারাপ আর বিষণ্নতার কিছু পার্থক্য রয়েছে।
বিষণ্নতা একটি আবেগজনিত মানসিক রোগ। দুঃখবোধের মতো সাধারণ আবেগ যখন অযৌক্তিক, তীব্র ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী (কমপক্ষে দুই সপ্তাহ) কোনো ব্যক্তিকে ঘিরে থেকে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন, কর্মতৎপরতা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে, তখন সেটাকে বলা হয় বিষণ্নতা। এতে মস্তিষ্কের ‘সেরোটনিন’-জাতীয় রাসায়নিক পদার্থের গুণগত ও পরিমাণগত তারতম্য ঘটে। যে কেউ যেকোনো সময় এতে আক্রান্ত হতে পারে। ধর্ম-বর্ণ, আর্থসামাজিক অবস্থান, যা-ই হোক না কেন, কেউই বিষণ্নতার ঝুঁকিমুক্ত নয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ নারী-পুরুষের বিষণ্নতা রয়েছে। যেকোনো বয়সে, এমনকি শিশুদের মধ্যেও এটি দেখা দিতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সে বিষণ্নতার লক্ষণ প্রথমবারের মতো দেখা যায়। এ ছাড়া ১৫ থেকে ১৮ বছর ও ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এর ঝুঁকি কিছুটা বেশি। ডায়াবেটিস, আর্থরাইটিস, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, স্ট্রোক, হৃদ্রোগ, মৃগীসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের বিষণ্নতা রোগ হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, একাকিত্ব, পারিবারিক ও সম্পর্কের সমস্যা, গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়, বিবাহবিচ্ছেদ, প্রবাসজীবন, অভিবাসন, মাদক সেবন ইত্যাদি কারণেও বিষণ্নতা রোগ হতে পারে।
বিষণ্নতার সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে, কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা, কোনো কিছু করতে ভালো না লাগা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হঠাৎ রেগে যাওয়া, আগে যেসব কাজ বা বিনোদন করতে ভালো লাগত, এখন সেগুলো ভালো না লাগা, মনোযোগ কমে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ করা, ঘুমের সমস্যা (যেমন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়া বা ঘুম না হওয়া অথবা বেশি ঘুম হওয়া), রুচির সমস্যা (যেমন খেতে ইচ্ছা না করা, খিদে না থাকা বা বেশি বেশি খাওয়া), শারীরিক মিলনস্পৃহা কমে যাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, সাধারণ বিষয় ভুলে যাওয়া, সব সময় মৃত্যুর চিন্তা করা, নিজেকে অপরাধী ভাবা, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা করা ইত্যাদি।
এ ছাড়া কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, এমন কিছু শারীরিক সমস্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়; বিশেষত নারী রোগীদের মধ্যে, যেমন মাথাব্যথা, মাথায় অস্বস্তি, মাথা-শরীর-হাত-পা জ্বালা করা, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা, শরীরব্যথা, ঘাড়ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বুকজ্বলা, বুকব্যথা, নিশ্বাসে কষ্ট ইত্যাদি। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব শারীরিক সমস্যার কারণ পাওয়া যায় না। নিজেকে খুব ছোট ও অপাঙ্ক্তেয় মনে হতে পারে, উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আচরণের অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণের সব কটি একসঙ্গে একজনের মধ্যে সব সময় থাকবে না আবার কয়েকটি লক্ষণ থাকলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে কারও মধ্যে বিষণ্নতা রোগ হয়েছে। বিষণ্নতা রোগ নির্ণয়ের জন্য অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্টের (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) সাহায্য নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা যায়, যাদের বিষণ্নতা রোগ রয়েছে, তাদের শতকরা ৪০ থেকে ৬০ ভাগের আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। মানসম্মত জীবনযাপন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে দ্রুত বিষণ্নতা শনাক্ত ও চিকিৎসা করা জরুরি।
বিষণ্নতা রোগের বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাতারাতি বিষণ্নতামুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। মনোরোগ চিকিৎসককে সময় দিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে এবং নির্দেশমতো ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
মন খারাপ
মন খারাপ কোনো রোগ নয়। একটি মৌলিক আবেগ। যেকোনো ক্ষতি বা আঘাতের পর মন খারাপ বা দুঃখবোধ একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া
সাধারণত ক্ষণস্থায়ী।
বেশির ভাগ সময়ই মন খারাপের কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
মন খারাপের জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
মন খারাপের কারণে কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায় না।
মন খারাপের তীব্রতা কম।
নারী-পুরুষ উভয়েরই মন খারাপ হওয়ার ঝুঁকি সমান।
মন খারাপ হলে সাধারণত শারীরিক লক্ষণ থাকে না।
বিষণ্নতা
বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন আবেগজনিত একটি মানসিক রোগ।
সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী। বিষণ্নতা রোগে মন খারাপ, কোনো কাজে আগ্রহের অভাব, কিছু শারীরিক লক্ষণ কমপক্ষে দুই সপ্তাহ থাকে।
বিষণ্নতার কারণ সব সময় জানা যায় না, কখনো কারণ থাকেও না।
বিষণ্নতা রোগের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।
বিষণ্নতার কারণে কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।
বিষণ্নতার তীব্রতা বেশি।
নারীদের মধ্যে বিষণ্নতা রোগ হওয়ার ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ।
বিষণ্নতা রোগে বেশ কিছু শারীরিক লক্ষণ, যেমন ঘুমের সমস্যা, রুচির সমস্যা, ক্লান্তিবোধ, শরীরে ব্যথা ইত্যাদি দেখা যায়।
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।